জুলাই চার্টার: পটভূমি ও সংস্কারপ্রস্তাব

শাসন অবসানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গণআন্দোলন সফল হয়। এরপর আন্তর্বর্তী সরকার প্রধান পরামর্শদাতা মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে জুন-জুলাই মাসে তীব্র আলোচনার মাধ্যমে একটি খসড়া “জুলাই জাতীয় চার্টার” প্রস্তুত করে। এই চার্টার বাংলাদেশকে মৌলিক ধাঁচে পুনর্গঠনের একটি রূপরেখা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কমিশন ঘোষণা করেছে, যা স্বাক্ষরের পর কোনও রাজনৈতিক দল চার্টারের বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে না এবং প্রয়োগের প্রতিটি ধাপে সংবিধানগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে চুক্তি হয়েছে; যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সংশোধন সংবিধানে বদল আনতে হবে। প্রধান সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, সংসদে বিরোধী দলীয় প্রতিনিধিদের জন্য স্থায়ী কমিটি চেয়ারম্যান, নির্বাচনী আসন পুনঃনির্ধারণ কমিটি গঠন, রাষ্ট্রপতির গোপন ভোটে নির্বাচনের সুপারিশ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করা, গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানিক ধারা-৭০ পরিমার্জন ইত্যাদি। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে ক্ষমতার মেরুদণ্ড হিসেবে গণতন্ত্রের বুনিয়াদি মজবুত হবে – একে অভিষিক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশের “জুলাই ম্যাগনা কার্টা” হিসেবে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোতে চূড়ান্ত খসড়া এখনও পাঠানো হয়নি।

নতুন সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা

কয়েকটি সংস্কার সরাসরি সংবিধানের সঙ্গে জড়িত থাকায় অনেকেই মনে করেন এগুলো একা ভোটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা নয়, বরং সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান ছাড়া টেকসইভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে না। জাতীয় নাগরিক পার্টির (NCP) সদস্য সচিব আক্তার হোসেন সম্প্রতি জানিয়েছেন, *“১৯টি সংস্কার সরাসরি সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত. এগুলো কীভাবে প্রয়োগ হবে সে বিষয়ে কোনো সহমত হয়নি, তাই নতুন সংবিধান ছাড়া টেকসই সমাধান নেই”*। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ইতোমধ্যে বিপুল ত্যাগ (সাড়ে আটশ শহীদ, ১৭০০ আহত) দিয়ে অর্জিত জুলা-বিপ্লবের ফলাফল যদি স্থায়ী না হয় তাহলে তার জবাব দেবে কে। অন্যদিকে, কমিশনের উপদেষ্টা প্রফেসর আলী রিয়াজও জানাচ্ছেন, কমিশনের কোনো বাস্তবায়ন ক্ষমতা নেই; তারা শুধু আলোচনা করে সরকারকে সুপারিশ জানাবে। অর্থাৎ, চার্টারে উল্লেখিত সংস্কারগুলো কার্যকর করতে হলে সংসদ বা গণভোটের মতো সংবিধানিক উপায় নিয়েই এগোতে হবে। এর ফলে সংসদে বহুসংখ্যক সংশোধন ছাপানোর চেয়ে সবাই চাইলে মূল কাঠামো উল্টে নতুন সংবিধান গড়া সহজ হতে পারে বলে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে।

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান

নিয়মিত রাজনৈতিক দলে বিভক্ত বাংলাদেশে জুলাই চার্টার বাস্তবায়নের নিয়ে দলগুলোর অবস্থান ভিন্নও বটে। এনসিপি নতুন সংবিধানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। তাদের যৌথ সমন্বয়ক জাভেদ রাসিনের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, চার্টারের সংস্কারগুলো জনগণের সর্বজনীন চাওয়া, তাই একটি সংবিধানসভা নির্বাচন করেই এগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত। তারা যুক্তি দিয়েছে, এতে ‘প্রতিনিধিসভা সরাসরি গণআন্দোলনকে প্রতিনিধিত্ব করবে’ এবং সংস্কার প্রক্রিয়াটি সব পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ও বৈধতা-বান্ধব হবে।

বিএনপি এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চার্টারের অধিকাংশ বিষয়ের সঙ্গে তারা একমত হলেও এগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তী নির্বাচিত সংসদকেই দায়িত্ব নিতে হবে। বিএনপি নেতারা জোর দিয়ে বলছেন যে, ঐক্যমতের সবকিছু নির্বাচন পরবর্তী সংসদে ২ বছরের মধ্যে আইন করে বাস্তবায়ন করা হবে এবং এটি *“একটি বৈধ প্রক্রিয়া”*। তারা যে কোন বৈধ ও সংবিধানগত উপায়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত রয়েছে এবং চার্টারে স্বাক্ষরের জন্যও প্রস্তুত বলে জানিয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী এর শীর্ষ নেতারা এই চার্টারকে আইনি স্বীকৃতি দিতে সরাসরি গণভোট করার পক্ষে আছেন। জামাতের একটি বর্ষীয়ান নেতা উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন যেমন ৫ম ও ৭ম সংশোধনী গণভোটের মাধ্যমে বৈধ হয়েছে; তাই এবারও চার্টারকে একই পদ্ধতিতে লোকভোটে আনার প্রস্তাব করেছেন। অন্য বিরোধী সংগঠন যেমন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বা নাগরিক ঐক্যও বিভিন্ন প্রস্তাব– যেমন সংবিধানসভা বা গণভোট – জানিয়েছেন। (আওয়ামী লীগ এই প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিতি বেঁধে রেখেছে।) এই অবস্থানগুলোর পার্থক্য স্পষ্ট যে, সংস্কার প্রণয়ন সর্বজনীন হলেও কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন তা নিয়ে তফাৎ আছে।

বাস্তবায়নের পথ

জুলাই চার্টার বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা চলছে বিভিন্ন উপায়ে। মূল যে চারটি পথের কথা উঠেছে তা হলো: ১) সংবিধানসভা (Constituent Assembly) নির্বাচন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, ২) পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে সংশোধন প্রণয়ন, ৩) পুরো বা আংশিক চার্টার নিয়ে গণভোট চালানো, এবং ৪) বিশেষ ব্যবস্থা (যেমন বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ) বা সংকর মডেল। কমিশন ও দলগুলোর আলাপ-আলোচনায় উল্লিখিত পথগুলোর মধ্যে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, সংসদকে সংস্কারসভায় পরিণত, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ ইত্যাদিও ছিল। স্থানীয় প্যানেলের পরামর্শ অনুযায়ী চারটি প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে: অর্ডিন্যান্স (বিধি-সমৃদ্ধ আদেশ), নির্বাহী আদেশ, গণভোট এবং বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।

সংবিধানসভা পন্থায় যদি এগুতে হয়, তাহলে সাধারণ নির্বাচনের পর একটি আলাদা নির্বাচিত সংবিধানসভা গঠনের কথা বলা হচ্ছে। পরবর্তী সংসদের পন্থায় দলগুলো নির্বাচনী মৈত্রী মেনশন করে আগামী সংসদেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২ বছরের মধ্যে সব সংস্কার প্রণয়ন করবে বলে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথাই মনে করছেন বিএনপি নেতারা। গণভোট পন্থায় জনগণের সরাসরি মত নিয়ে বৈধতা পাবে বলেও জামাত পক্ষের যুক্তি; তবে জুন মাসে কমিশন গণভোটের প্রস্তাব টুকরো করেছিল সময় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায়। বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ বা সংকর প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রপতির একান্ত আদেশে বা অস্থায়ী কমিটি করে প্রয়োগের কথা উঠে এসেছে।

পদ্ধতির সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ

সংবিধানসভা: সরাসরি জনগণের প্রতিনিধিদ্বারা প্রণয়ন হওয়ার ফলে ব্যাপক লেগিটিমেসি ও গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর সুযোগ আছে। তবে এতে নতুন নির্বাচন ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া লাগবে, এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংকট এড়ানো কঠিন হতে পারে।

সংসদীয় পদ্ধতি: বিদ্যমান সংবিধান ও জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় এগোনোর সুবিধা হলো প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে, সময়নিষ্ঠার আশ্বাস থাকে। কিন্তু সংবিধানের ২/৩ ভোট বা পার্লামেন্টারি নৈরাজ্য এড়িয়ে চলা বাধ্যতামূলক, আর বিরোধীদের অংশগ্রহণ ছাড়া সফলতা সন্দেহজনক।

গণভোট: সর্বজনীন জনমতের দ্বারা বৈধতা দেয়ার সুবিধা থাকলেও এতে উচ্চ ব্যয়, সময়, এবং রাজনৈতিক বিভক্তি জন্মার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে বর্তমান অস্থির পরিস্থিতিতে যে সময় নিয়ে গণভোট হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।

বিশেষ আদেশ/সংস্কার: খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে এর সংবিধানগত বৈধতা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। যেমন, বিএনপি নেতারা সতর্ক করেছেন যে *“যদি প্রক্রিয়াগত ত্রুটি হয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগ মেলে, চার্টারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে”*।

পরবর্তী সম্ভাব্য দৃশ্যপট

কমিশন এবং অংশগ্রহণকারী দলগুলো এখন জুলাই চার্টার সম্পাদনীয় কাগজ চূড়ান্ত করে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানা গেছে, আগামী ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দলগুলোকে নিজেদের প্রতিনিধিকে স্বাক্ষরের জন্য নাম জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে এসব সংস্কার আইন আকারে পাকা করা হতে পারে। এনসিপি জানিয়েছেন, সব রাজনৈতিক দল একমত হলে ডিসেম্বরে সংবিধানসভা নির্বাচন হতে পারে, আর বিএনপি মনে করে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের পর ২ বছরের মধ্যে সব সংস্কার গৃহীত হবে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ইন্টারিম সরকারের মেয়াদেই (পরবর্তী নির্বাচনের আগে) অ-সংবিধানগত ব্যবস্থা যেমন অর্ডিন্যান্স জারি করে কিছু সংস্কার শুরু হয়েছে, তবে সংবিধান সংশোধন অভ্যন্তরীণ পথেই শেষ করা জরুরি।

সব মিলিয়ে, যুক্তিহীন ব্যর্থতা এড়াতে রাজনৈতিক ঐক্যই এখন বড় চাবিকাঠি। যদি চার্টার সফলভাবে প্রণয়ন ও প্রয়োগ হয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি গতিশীল বিশ্বস্ততার বুনিয়াদ পাবে। কিন্তু যদি পার্থক্য টিকিয়ে রাখা হয়, তাহলে ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের ত্যাগ বৃথা যেতে পারে এবং ভবিষ্যৎ দূস্কালের আশঙ্কা জাগবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও শাসনতন্ত্রের জন্য এ মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা দেশের রাজনৈতিক চিত্রকে গতিশীল অথবা বিপথগামী হতে পরিণত করবে।

Source

The Daily Star

Dhakatribune

Bdnews24

Prothomalo

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *