১. মানবাধিকারের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ: কেন জাতিসংঘের পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে—গণতান্ত্রিক সংকট, রাজনৈতিক নিপীড়ন, জাতিগত সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, এবং বিচারহীনতার মতো সমস্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। এই বাস্তবতায় জাতিসংঘ মানবাধিকার উচ্চ-কমিশনারের অফিস (OHCHR) তার নীতিগত অবস্থান ও কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বে ন্যায়বিচার ও মানব মর্যাদা রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাতিসংঘের এই পদক্ষেপগুলো কেবল প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং প্রতিরোধমূলকও। অর্থাৎ, যখন একটি দেশে সহিংসতা শুরু হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন সেই সংকট নিরসনে জাতিসংঘ সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায়। এই কারণে OHCHR মিশনের উপস্থিতি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নয়, বরং বৈশ্বিক মানবাধিকার কাঠামোর অংশ হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
২. UN Human Rights Commission (OHCHR) কী? এবং এর দায়িত্ব কী?
জাতিসংঘের মানবাধিকার উচ্চ-কমিশনারের অফিস (OHCHR) হলো জাতিসংঘ সচিবালয়ের একটি বিভাগ, যার কাজ আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার প্রচার ও সংরক্ষণ করা। এই অফিস মানবাধিকার পরিষদের (UNHRC) সচিবালয় হিসেবেও কাজ করে এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় মানবাধিকার সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড সমন্বয় করে। সংক্ষেপে, OHCHR বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. কোন কোন দেশে OHCHR অফিস আছে এবং কী করেছে তারা সেসব দেশে?
UN মানবাধিকার অফিস (OHCHR) বিভিন্ন দেশে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ:
কোলম্বিয়া: এখানে শান্তি-প্রতিষ্ঠার পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সহিংসতা নিরীক্ষণে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিলে কলম্বিয়ায় শান্তি-প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছে।
প্যালেস্টাইনের গাজা: সাম্প্রতিক সংঘর্ষে উভয়পক্ষের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ইসরাইলি বিমান হামলায় শতাধিক বেসামরিক নিহতের ঘটনা ফুটে উঠেছে এবং তা “যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
কাম্বোডিয়া: এখানে খেমার রুজ যুদ্ধাপরাধের বিচারে জাতিসংঘের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিচারের অবকাঠামো দৃঢ় করেছে।
সুদান (দারফুর): এখানে গণহত্যা তদন্তের জন্য স্বাধীন একটি মিশন গঠন করে সংঘটিত অপরাধের তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিবেদন করেছে।
ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো: ২০২৪ সালে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেটি অর্থসংকটে কাজ শুরু করতে পারেনি।
প্রতিটি দেশের অভিজ্ঞতা আলাদা। কিছু দেশে (যেমন ডিআর কঙ্গো বা কলম্বিয়া) আইনি পদক্ষেপ এবং শান্তি প্রক্রিয়ায় সহায়তার কিছু সাফল্য হয়েছে, আবার অনেকক্ষেত্রে শুধু তদন্ত-প্রতিবেদন তৈরি করেই থামতে হয়েছে।
৪. বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে: কেন OHCHR অফিস এখন দরকার?
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধীদের বিরুদ্ধে নির্বিচার গ্রেপ্তার, গায়েবি খুন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, এসব ঘটনার ফলে বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিশ্রুতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরাও নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতা, গ্রেপ্তার ও গণধারণের ব্যাপকতার প্রতি “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারকর্মীরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে সরকার উচিত OHCHR-এর সহযোগিতায় একটি “বিশেষ তদন্ত কর্মসূচি” গড়ে তোলা, যাতে enforced disappearances এবং নির্বিচার হত্যার অভিযোগগুলো তদন্ত করা যায়।
৫. সাম্প্রতিক MOU ও UN অফিস খোলার সিদ্ধান্তের তাৎপর্য
আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষ: UN মানবাধিকার মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার ও OHCHR এই সপ্তাহে তিন বছরের একটি MoU স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে দেশে মানবাধিকার প্রচার ও সুরক্ষার লক্ষ্যে একটি মিশন স্থাপন করা হবে। তিনি বলেন, এই চুক্তি দেশের মানবাধিকার অঙ্গীকারের গুরুত্ব বোঝায় এবং সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
সরকারের বক্তব্য: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই মিশন সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দেবে এবং বাংলাদেশকে তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাধ্যবাধকতা পূরণে সহায়তা করবে। এছাড়া সরকার নিশ্চিত করেছে যে মিশন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সম্মান করে এবং কোনও বৈদেশিক এজেন্ডা চাপাবে না।
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া: Hefazat-e-Islam বাংলাদেশসহ কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছে। Hefazat নেতারা বলেছেন, “সরকারি দল দীর্ঘ ১৬ বছরের ঔপনিবেশিক হত্যাকাণ্ড ও গায়েবি খুনের বিচার না করে বিদেশি সংস্থা আনছে,” এবং ঘোষণা দিয়েছে তারা ঢাকায় এই মিশন প্রতিষ্ঠা করতে দেবে না।
সরকার এবং জাতিসংঘ উভয় পক্ষই এই মিশনের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু স্থানীয় রাজনীতির বাস্তবতা বুঝতে হবে।
৬. অন্যান্য দেশে এই মিশনের ফলাফল: সাফল্য না ব্যর্থ?
ডিআর কঙ্গো: এখানে যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু তহবিল সংকটে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
গাজা অঞ্চল: UN-গঠিত তদন্ত কমিশন গাজার সংঘর্ষ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তবে ইসরাইল এতে অংশ নেয়নি এবং প্রতিবেদনকে পক্ষপাতি অভিযোগ করেছে।
উগান্ডা: ২০০৬ সাল থেকে Kampala-তে OHCHR অফিস থাকলেও ২০২৩ সালে দেশটি ঘোষণা করেছে ম্যান্ডেট নবায়ন করা হবে না, এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা আছে বলে দাবি করেছে।
ভেনেজুয়েলা: মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কঠোর সমালোচনার পর জাতীয় সংসদ UN হাই কমিশনারকে persona non grata ঘোষণা করেছে। ফলে সরকার UN কার্যালয়ের কর্মীদের ফের দেশ থেকে তাড়ানোর হুমকি দিয়েছে।
সংক্ষেপে, অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতির বাধা এবং অর্থায়নের সমস্যা OHCHR-এর প্রচেষ্টা আটকে দিয়েছে। কোথাও সহায়তা পেয়েও (যেমন কলম্বিয়া) কাজ হয়েছে, আবার কোথাও (যেমন গাজা, উগান্ডা) সরকার অসহযোগিতার কারণে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত।
৭. বাংলাদেশে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
বাংলাদেশে এই মিশন কার্যকর করতে গিয়ে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে:
ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বাধা: Hefazat-এর মতো গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখে। তাই মিশনকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতি সংবেদনশীল থাকতে হবে।
আইন ও সার্বভৌমত্ব: সরকার সবসময় দেশের আইন ও সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রয়োজনে জাতীয় আইন সংশোধন করে OHCHR-এর কাজকে বৈধ ভিত্তিতে রাখতে হবে।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করতে হবে, যেন তারা OHCHR-এর সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করতে পারে।
স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ: মিশনটি স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হলে জনগণের আস্থা বাড়ে। নিয়মিত অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জনগণকে অবহিত রাখতে হবে।
৮. উপসংহার:
অবশেষে বলা যায়, OHCHR মিশনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে নয় বরং গণতন্ত্র রক্ষার অংশ হিসেবে দেখতে হবে। এর উদ্দেশ্য ক্ষমতাকে বিচক্ষণ করতে বাধ্য করা এবং বিচারহীনতা দূর করা। যেমন অন্যান্য দেশে UN সহায়তায় বিচারপ্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক সহায়তা নাগরিক অধিকার রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। সাহসী নেতৃত্ব ও স্বচ্ছতামূলক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই উদ্যোগ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারগুলোকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।
তথ্যসূত্র:
- OHCHR
- Reuters
- Human Rights Watch
- Al Jazeera
- TBS

